২১শে ফেব্রুয়ারী ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : বাংলা ভাষার বিশ্বজয়
মকিস মনসুর॥ মায়ের গর্ভ থেকে এসেই আমরা প্রথম যে ভাষার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তাহা হলো আমার প্রানের বাংলা। মাতৃভাষা বিশেষ কোনো ব্যক্তি-মানুষের যেমন অন্যতম পরিচয়-উৎস, তেমনি তা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্বেরও শ্রেষ্ঠ স্মারক। মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতোই প্রিয়, মাতৃভাষা তার অন্যতম। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে, তুলে ধরে তার জাতিসত্তার পরিচয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোনো জাতিই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, পারে না নিজের পরিচয়কে পৃথিবীতে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করতে। যে জাতির মাতৃভাষা যত উন্নত, সে জাতি সব দিক থেকেই তত উন্নত-এমন ধারণা সর্বজনস্বীকৃত। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীতে অনন্য ভাষার চেয়ে গর্বের এই জন্য যে, তা একটি রাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশ ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। আমাদের দেশই পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। বাঙালির ইতিহাসে মাথা উঁচু করে বলার মত যত ইতিহাস রচিত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলা ভাষার ইতিহাস অন্যতম। ইতিহাসে হার না মানা বাঙালি জাতির পরিচয় যে বাংলা ভাষা, সেটি বিশ্বজয় করতে সময় লেগেছে মাত্র ৫২ বছর। এই ৫২ বছরের ৫২ সালের ইতিহাসের যেমন অবয় ঘটবে না বাঙালি হৃদয় থেকে, তেমনি বিশ্ব মানচিত্রে একমাত্র ভাষার জন্য রক্তদাতা জাতি হিসাবে সমুন্নত থাকবে বাঙালির শির। মানুষের ভাষা ব্যবহারের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান সপ্তম। পৃথিবীতে চার সহ¯্রাধিক ভাষার মধ্যে সপ্তম স্থানে থাকা বাংলা ভাষা প্রকৃত অর্থেই দাবি করতে পারে গৌরবের আসন। বিশ্বের প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ সংখ্যাতত্ত্বও আমাদের মাতৃভাষায় গৌরবের অন্যতম ভিত্তি-উৎস।
ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ বরকত-রফিক-সালাম-জব্বারকে বাঙালি জাতি ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। তাঁদের সাহসী ভূমিকা ও গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের ফলেই পাকিস্থানি ঔপনিবেশিক শক্তির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়, রা পায় বাংলা ভাষার অনন্য গৌরব। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা রার অস্তিত্বের রাজপথের মিছিলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, মশিউর এর রক্তের বিনিময়ে আমাদের বাংলা ভাষা আমাদের বর্ণমালা, ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত দিনটিই মহান শহীদ দিবস হিসাবে জাতি পালন করে আসছে। একুশের পথ ধরেই বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি বাংলার স্বাধীনতা, লাল বৃত্ত সবুজ পতাকা, একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের গৌরব ও গবের প্রতীক। আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো সদর দফতরে প্রস্তাব পাঠানোর পর দীর্ঘ পরিক্রমায় ২০০০সালে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিশ্বজয় তথা আরেকটি নব ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। আমাদের মাতৃভাষার জন্য এ এক বিশাল গৌরব। যাহা আজকের এই লেখার মাধ্যমে আবার উপস্থাপন করছি।
২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ পরিণত করার ভাবনা প্রথমে আসে কানাডার ভাংকুভারে প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের মাথায়। বাংলা ভাষা রার জন্য বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছে, কাজেই তাদের এই অবদানের সম্মানার্থে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে যেন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করা হয়, এ ব্যাপারে তারা ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে চিঠি লেখেন। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করার এই দাবি উপস্থাপন করেন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিক একটি গোষ্ঠী। দাবির সমর্থনে স্বার করেন সাত জাতির সাত ভাষার ১০ জন সদস্য। ইতিমধ্যে প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে। এরপর জাতিসংঘ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে তারা বিষয়টি প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে প্রেরণ করেন। সেখান থেকে তাদের ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে জানানো হলো, ‘তোমাদের বিষয়টি খুবই ইন্টারেস্টিং, ইউনেস্কো এ ধরনের প্রস্তাব পেলে আলোচনা করে থাকে। বিষয়টি অক্টোবরে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ইউনেস্কো সম্মেলনে তুলতে হবে এবং তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প থেকে হলে চলবে না, কোনো সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক অফিসিয়াল ভাবে উত্থাপন করতে হবে।’ এরপর রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম বিষয়টি সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের শিা মন্ত্রণালয়ে পাঠান। এদিকে হাতে সময় ছিল খুবই কম। কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনেস্কো সদর দফতরে এ প্রস্তাব পাঠানোর শেষ তারিখ ছিল ১০ সেপ্টেম্বর।
তৎকালিন শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টি তাৎণিকভাবে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আনলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে সময় নষ্ট না করে ত্বরিত সিদ্ধান্ত দেন প্রয়োজনীয় পদপে নেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে শিা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা সংরণ’ সম্পর্কিত ইউনেস্কোর নীতিমালার আলোকে ইউনেস্কোর ৩০ তম সাধারণ সম্মেলনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করার ব্যাবস্থা করা হয়।
প্রস্তাবটি প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দফতরে নেয়া হয়। এরপর ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কো সচিবালয়ে এ প্রস্তাব নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বাজেটের কথা বিবেচনা করে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। মহাপরিচালকের মতামত এই প্রস্তাবটিকে রীতিমতো অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের শেষ আশা জাগিয়ে তোলে ইউনেস্কোর অধিবেশনে যোগদানকারী শিামন্ত্রীর নেতৃত্যে একটি বড়সর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, দতা ও বিচণতা এ ব্যাপারে মূল্যবান অবদান রাখে। ইউনেস্কোর ডেপুটি মহাসচিব কলিন পাওয়ারের সঙ্গে সাাৎ করে তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, আমাদের প্রস্তাাবে যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো, পৃথিবীর বুক থেকে দ্রুত বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রা করা এবং তা টিকিয়ে রাখার লে বৃহত্তর সচেতনতা গড়ে তোলা। বাংলাদেশের প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একজিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণের সুপারিশ করেন। পাকিস্থানসহ সার্ক এবং প্রতিবেশী অন্যান্য ২৮ টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাবকে লিখিতভাবে সমর্থন জানায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রস্তাবটি যদি একবার পরিা-নিরিার জন্য একজিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণ করা হতো তাহলে আর কোনো দিন তা আলোর মুখ দেখত বলে মনে হয় না। ইউনেস্কোর টেকনিক্যাল কমিটি কমিশন-২ এ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী উত্থাপিত হয় ১২ নভেম্বর। কারো কোনো আপত্তি না থাকায় সভাপতি তিনবার হাতুড়ি পিটিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হলো বলে ঘোষণা দিলেন। হাততালিতে মুখরিত হলো সম্মেলন ক।
এরপরের ঘটনা গতানগতিক। কমিশন-২-এ পাস হওয়া প্রস্তাবটি ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সাধারণ সম্মেলনে রুটিন বিষয় হিসেবেই গৃহীত হয়। ৪ জানুয়ারি ২০০০ তারিখে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কাইচিরো মাটসুরা এক চিঠিতে ইউনেস্কোর সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি তখন থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু মাতৃভাষার জন্য আমাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকেই স্বীকৃতি দেয়নি, অমর একুশের শহীদদের আতœদান থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জনকেও মর্যাদা দিয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের পৃথিবীর বুকে মহিমান্বিত করেছে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ২১৫ টি দেশে প্রতি বছর আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে উদযাপন করে আসছে।
লেখক পরিচিতি: বৃটেনের কমিউনিটি সংগঠক ও মৌলভীবাজার জেলার সাবেক ছাত্রনেতা মকিস মনসুর আহমদ, সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ডেইলি সিলেট এন্ড দৈনিক মৌমাছি কন্ঠ. সম্পাদক, ওয়েলস বাংলা নিউজ ও দৈনিক মৌলভীবাজার ডট কম, ওয়েলস প্রতিনিধি এটিএন বাংলা ইউকে, সাবেক এম্বাসেডর ইউকে বাংলা টিভি।
মন্তব্য করুন