২৩ শে জুন-পলাশী দিবস শহীদ সিরাজুদ্দৌলার দুইশত আটান্নতম শাহাদাত বার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলী
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ তেইশ জুন-পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন, বৃহস্পতিবার ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ মহকুমায় নবাব মুর্শিদকুলি খানের স্মৃতি বিজড়িত বাংলার তৎকালীন রাজধানী ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের অদুরে “পলাশীর পান্তরে” প্রহসন মূলক পলাশীর যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব, মনসুরুল-মূলক মির্জা মহাম্মদ সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় ও পতন এবং “ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর” কর্নধার কর্নেল ক্লাইবের বিজয় ভারত বর্ষে বৃটিশ সম্্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। বনিকের মানদন্ড দেখা দেয় রাজদন্ড রূপে পোহালে শর্বরী। পলাশীর আ¤্রকাননে নবাব সিরাজদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান এবং রায় দূর্লভ, রাজ বল্লভ, জগৎ শৈঠ, উমি চাঁদ প্রমুখ এবং তার দোসরদের সহায়তায় সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর সুবিশাল প্রান্তরে যে বিষবৃক্ষ রোপন করছিলেন, ভারতবাসীকে একশত নব্বই বৎসর তার কুফল ভোগ করতে হয়েছে। “কাফারা”- দিতে হয়েছে। নবাব আলী বর্দি খানের মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র, প্রিয় সহচর ও যোগ্য উত্তরসুরী মির্জা মোহাম্মদ সিরাজুদ্দৌলা তরুন বয়সে বাংলা, বিহার, উরিষ্যার সিংহাসন আরোহন করেন। অল্প বয়সেই কিশোর সিরাজ প্রিয় দাদু নবাব আলীবর্দি খানের সঙ্গে সুখে-দুঃখে-দিবসে-নিশিতে সঙ্গে থেকেছেন, বৃদ্ধ নবাবকে ছায়ার মত অনুসরন করেছেন। ফলতঃ কিশোর বয়সেই তরুন নবাব সিরাজ ছিলেন স্বদেশ প্রেম ও স্বাদেশিকতায় উদ্ভোদ্ধ একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক। সিংহাসন আরোহন করেই নবাব সিরাজ ঘরে-বাহিরে শত্রুর সম্মুখীন হন। সামন্ত যুগে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিয়ে গৃহ বিবাদ ছিল সামন্ত সংস্কৃতির অংশ। বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দি খানের জীবিতাবস্থায় কুচক্রী ঘসেটি বেগম, নবাবের পরমাত্মীয়, ভিনদেশী সিপাহসালার, মীর জাফর আলী খান এর বদনজর ছিল বাংলার মসনদের দিকে। বাংলার অপরূপ প্রকৃতিক নিসর্গ, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, সনীল জলরাশি এবং বিপুল ধন সম্পদের প্রতি বরাবরই বিদশীদের নজর ছিল। বাংলাদেশের বিপুল পরিমার ধন সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এদেশে এসেছেন- মুঘল, পাঠান, ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ-রা। ভারতবর্ষে বানিজ্য করতে আসা “ইউনাইটেড ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী” – “ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী”- ঘাটি স্থাপন, বিনা শুল্কে বানিজ্য এবং বানিজ্যিক কারনে এতদাঞ্চলে শক্তি সঞ্চয় ও প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। স্বাধীন চেতা তরুন নবাব সিরাজুদ্দৌলা স্বদেশপ্রেম ও স্বাদেশীকতায় উদ্ভোদ্ধ হয়ে বাংলার মান মর্যাদা, বাংলার স্বাধীনতা-রক্ষায় ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নবাব সিরাজ কোন অন্যায়ের কাছে মস্তক অবনত করেননি, নতি স্বীকার করেন নি। আপোষ করেন নি। ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা করেননি, বরং কোম্পানীর ঐদ্যত্ব ও প্রভাব বিস্তারে কঠোর সতর্কবানী উচ্চারন করেছেন, স্বাধীন চেতা তরুন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। ফলতঃ তাঁকে কোম্পানীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়েছে।
অবিরাম প্রসাদ ষড়যন্ত্র, সেনাপতি মীর জাফরের মীরজাফরি-মোনাফোকি এবং ক্লাইব-কোম্পানীর সামরিক শক্তি বৃদ্ধির শেষ পরিনতি পলাশীর যুদ্ধ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বিস্যোদবারের পলাশীর যুদ্ধ। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। পলাশীর যুদ্ধের প্রথমভাগে দেশ প্রেমিক -“বাংলাবাহিনী”- যখন ইংরেজ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন বিশ^াসঘাতক মিরজাফরের বিশ^াসঘাতকতায় -“বাংলাবাহিনী”- যখন যুদ্ধ বিরতী সহ বিশ্রামরত তখন অতর্কিতে মিজরজাফরের অদৃশ্য ইঙ্গিতে ইংরেজ সৈন্যরা আক্রমন করে বসে। পলাশীর যুদ্ধের ঘৃন্যতম ষড়যন্ত্রের খলনায়ক সোনপতি মীর জাফর আলী খানের নির্দেশে চল্লিশ হাজার নবাব সৈন্যরা এবং সেনাপতি রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফরা পুতুলের মত দাড়িয়ে রইলেন। নবাবের অনুগত বাজা মোহন লাল মীর মদন তার অনুগত সামান্য সৈন্য বাহিনী নিয়ে প্রতিরোধ করতে না করতেই পলাশীর যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় বাংলার হতভাগ্য নবাব সিরাজুদ্দৌলার। মীর জাফর-ক্লাইবের কাছে আত্মসমর্পন করেন নি, আপোষ করেননি, প্রান ভিক্ষা চাননি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। শহীদ হলেন। প্রাণ উৎসর্গ করলেন। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার-স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ হলেন মির্জা মোহাম্মদ সিরাজুদ্দৌলা। নবাব সিরাজুদ্দৌলা। মাত্র তেইশ শত সৈন্য গোটা কতেক ছোট কামান নিয়ে বিনা যুদ্ধেই বিজয়ের শেষ হাসি হাসলেন কোম্পানীর কর্নধার রবার্ট ক্লাইব। কর্নেল ক্লাইব।
তেইশে জুন পলাশীর বিপর্যয়, সিারজের পতন ও শাহাদাত বরনের পর মুর্শিদাবাদে ভাগিরথী নদীর তীরে -“খোশবাগে”- চীর শয়ানে শয়িত আছেন নাবাব সিরাজুদ্দৌলা। এই খুশবাগে শায়িত আছেন প্রিয় দাদু নবাব আলীবর্দি খান, প্রিয় পতœী বেগম লুৎফুননেছা এবং নাবাব পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। অনুসন্ধানী সাংবাদিক-কবি আব্দুল হাই শিকদার, বিশিষ্ট পর্যটক-লেখক লিয়াকত হোসেন খেঅকন প্রমুখ লেখক-গবেষকগন সিরাজের স্মৃতি বিজড়িত মুর্শিদাবাদ-পলাশীর প্রান্তর ভ্রমন করেছেন। দেখেছেন পলাশীর আ¤্রকাননে একটি আমগাছও নেই। নেই পলাশীর যুদ্ধের কোন স্মৃতিচিহ্ন। শুধুমাত্র তির তির করে বয়ে চলেছে ভাগিরথী নদী। সিরাজুদ্দৌলা-পলাশী এখন শুধুই উজ্জল স্মৃতি মাত্র।
২০১৭ সালের ২৩ শে জুর পলাশীর দিবসের শহীদ সিরাজুদ্দৌলার ২৫৮ তম শাহাদাত বার্ষিকী। এই ঐতিহাসিক দিবসে শহীদ সিরাজুদ্দৌলার উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তাঁর বেহেশ্ত নসিব করুন- এই মোনাজাত করছি।
[সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি ও মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধ]
মন্তব্য করুন