৪র্থ শিল্পবিপ্লব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রাথমিক শিক্ষা
আমেনা আক্তার॥ প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বিপ্লবকে বলা হয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বিশ্ব এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে।
বাংলাদেশ রয়েছে তার দ্বার প্রান্তে। এই শিল্পবিপ্লব মোকাবেলায় প্রয়োজন দক্ষ মানব সম্পদ।
আর মানব সম্পদ তৈরি করতে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। মুখস্থ করার পরিবর্তে আত্নস্থ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
এরমধ্যে অন্যতম পদক্ষেপ গুলো হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম, প্রি প্রাক-প্রাথমিক চালু, আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান, ডিজিটাল ক্লাসরুম ইত্যাদি।
যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল সুচিন্তার অধিকারী, সমস্যা সমাধানের পটু হিসেবে গড়ে তুলবে।
শুধুমাত্র পাঠ্যবই কেন্দ্রিক লেখাপড়া থেকে বের হয়ে কর্ম নির্ভর ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করবে।
আগামী ৩০ বছর পর যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, যারা হবে এই দেশের নীতিনির্ধারক তারা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তুতির সময় এখনই।
২০২৩ সালের পরিমার্জিত কারিকুলামে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন দূরদর্শী অভিযোজনের সক্ষম মানবিক এবং যোগ্য বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন ও মূল্যবোধ চর্চা খুবই প্রয়োজন।
আর এসব দক্ষতা অর্জনে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকবৃন্দকে সর্বদা নিরলস ভূমিকা রাখতে হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিশীল হলেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তন, সমস্যার সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্ব-ব্যবস্থাপনা, সহযোগিতামূলক যোগাযোগ, জীবিকায়ন এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার মতো দক্ষতা অর্জন সহজ হবে।
শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে বিশ্ব নাগরিক। তবে উল্লেখিত সকল দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত সংখ্যক নেতৃত্ব গুণ সম্পন্নপেশাদার দায়িত্বশীল ও নিবেদিত শিক্ষক প্রয়োজন।
একজন শিক্ষককে হতে হবে আধুনিক যুগোপযোগী, শিক্ষাদানের বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান, উপকরণের যথাযথ ব্যবহার ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল ক্লাস পরিচালনায় দক্ষ।
তাই যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত শিক্ষক গড়ে তুলতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
আর মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চিতের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
এর ফলে শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এখনো অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার হাওরাঞ্চল ও চা অধ্যুষিত এলাকা।
হাওর অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার খুবই কম এবং ঝরে পড়ার হার বেশি।
অধিক বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, বন্যা হাওর অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।
হাওরাঞ্চলে প্রায় ছয় মাস মানুষ পানি বন্দি অবস্থায় থাকে। এসময় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা।
ফলে সে সময় শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার আগ্রহ টুকু হারিয়ে ফেলে।
তাছাড়া শুকনো মৌসুমে ধান হচ্ছে একমাত্র উৎপাদিত ফসল। এই ফসলের উপর তাদের সারাবছরের জীবিকা নির্ভর করে। ছোট বড় সকলেই সেই সময় কাজে ব্যস্ত থাকে।
ফলে শুকনো মৌসুমে লেখাপড়ার জন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও খুবই কম থাকে।
অপরদিকে চা বাগানের শ্রমিকদের সন্তানেরা প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সাধারণত চা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসতেই দেওয়া হয় না।
যদিও চা বাগান কর্তৃপক্ষ এবং এনজিওগুলোর সহায়তায় বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে কিন্তু এখানে দক্ষ শিক্ষক ও যথার্থ সুযোগ সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীরা সহজে ঝরে পড়ে।
চা বাগানের অভিভাবকগণ নিরক্ষর বলে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে তেমন অবদান রাখতে পারে না।
যুগ যুগ ধরে অবহেলিত চা জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবনযাপনের পাশাপাশি তাদের মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
চা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা করা হলেও তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি।
সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন তথা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য এসব সুবিধা বঞ্চিত এলাকার শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও মান উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন।
-লেখক : ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) পিটিআই, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন