March 21, 2017,

তেইশে মার্চ একাত্তোর-পাক-প্রজাতন্ত্র দিবস : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের-প্রতিরোধ দিবস : ইতিকথা: স্মৃতিকথা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ তেইশে মার্চ-উনিশ-শ-একাত্তোর সাল। তৎকালীন বিশ্বের বর্ণিত বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র কথিত-ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের-“রিপাবলিক ডে-প্রজাতন্ত্র দিবস”-। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে প্রতিরোধ দিবস-প্রটেষ্ট ডে-হিসাবে ঘোষনা করেন তৎকালীন “স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-স্বাছাপ। পরিষদ এর নেতা চতুষ্টয় ছিলেন রব, (আসম আব্দুর রব, ডাকসুর ভিপি স্বাধীনতার পতাকাউত্তোলক), সিরাজ-(শাহজাহান সিরাজ) সিদ্দিকী, (নূরে আলম সিদ্দিকী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক। ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় নেতা।) মাখন (আব্দুল কদ্দুছ মাখন, ডাকসুর জি এস অকাল প্রয়াত)।
তেইশেমার্চ-একাত্তোরের পাক প্রজাতন্ত্র দিবসে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক পাকিস্তানী অবকাঠামোর মধ্যেই প্রটেষ্ট ডে প্রতিরোধ দিবস-পালনের প্রেক্ষাপট এবং প্রাসঙ্গিতা প্রসঙ্গে কিঞ্চিত আলোচনা-পর্য্যালোচনা একান্তই প্রাসঙ্গিক।
পাকিস্তানী ঔপনিবেষিক শাসনামলে পাকিস্তানের গনধিকৃত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রী কায়েমী শাসক গোষ্টি বরাবরই বাংলা ও বাঙ্গালির প্রতি বিমাতাসুলভ আচরন করেছে। পাক স্বাধীনতার উষালগ্নে গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা সফরে এসে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে সদম্ভে ঘোষনা, করেন-উর্দূ এন্ড উর্দূশেল বিদি স্টেইট লেঙ্গয়েজ অব পাকিস্তান-” উর্দূ এবং একমাত্র উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। জিন্নাহর  ঘোষনা-মানি না-মানব না-বলে প্রতিবাদ উঠল বাংলায়। সেই থেকে শুরু। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বায়ত্ত শাসন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিকছয় দফা কর্ম্মসূচী ঘোষনা এবং-ছয়দফা ভিত্তিক প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন এর আন্দোলন, উনসত্তোর সালে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের এগারো দফার ছাত্রগনআন্দোলন গণ অভ্যোত্থানে রূপ নিলে পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেঃ আগা মোঃ ইয়াহিয়া  খান আন্দোলনও বাঙ্গলিদের কাছে নতি স্বীকার করতঃ সাধারন নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। পূর্বে ১৯৬২-সালে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষে সাবেক ছাত্রলীগনেতা-রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তক সিরাজুল আলম খান গোপন সংগঠন-নিউক্লিয়াস-” গঠন করে ছিলেন। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক (পরেমন্ত্রী। মরহুম) এবং কাজি আরিফ আহমদ (জাসদের কেন্দ্রীয় সভাপতি। আততায়ীর হস্তে নিহত)। রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তক-তাত্বিক সিরাজুল আলম খাঁন মরমে মরমে অনুধাবন করেছিলেন স্বার্থপর পাঞ্চাবীদের সঙ্গে বাঙ্গালিদের পোষোবে না, তাই বাংলা ও বাঙ্গালির স্বাধীন-স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রয়োজন। স্বাধীনতার গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াসের শাখা ও কার্য্যক্রম মফস্বল পর্য্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দেওয়ান নূরুল হোসেন চঞ্চল (মুজিব বাহিনীর সংঘটক। পরলোকে) এবং আখতার আহমদ (পরে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা। পরলোকে) নিউক্লিয়াসের কর্মি সংগঠক ছিলেন। নিউক্লিয়াস “স্বাধীন বাংলা” বিপ্লবি পরিষদ- নামে অভিহিত। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে সংগঠিত-ত্বরান্বিত এবং চুড়ান্ত পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস এবং নিউক্লিয়াসের প্রতিভাবান ও মেধাবী কর্মি বাহিনীর ব্যাপক ইতিবাচক অবদান ছিল। নিউক্লিয়াস ¯্রষ্টা-তাত্বিক সিরাজুল আলম খাঁন এবং তার সহযোগি আব্দুর রাজ্জাক-মুজিব বাহিনীর-আঞ্চলিক অধিনায়ক ছিলেন।
ষাটের দশকের শুরুতে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদে উদ্ভোদ্ধ হয়ে বাংলাও বাঙ্গালির মুক্তির লক্ষ্যে ছাত্রলীগের কর্মি হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলাম। ৬২ সালে কুখ্যাত, হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবীতে-ছাত্রহত্যার বিচারচাই, আয়ূব শাহীর পতন হউক-শ্লোগান দিয়ে সেই যে মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম জীবন সায়ান্যে এই পড়ন্ত বেলায় এখনও মিছিলের প্রতি একটি মায়া অনুভব করি। ঐ দশকে মৌলভীবাজার মহাবিদ্যালয় শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছাত্রলীগের সম্মেলন, সভা সমাবেশ এবং রাজনৈতিক কারনে রাজধানী ঢাকায় আসা যাওয়ার কারনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয়, সম্পর্ক ও সখ্যতা গড়ে উঠে। তখন থেকে আমার লেখালেখি এবং বক্তৃতা ও সাংঘটনিক দক্ষতার কারনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ¯েœহমমতা পাই, সুদৃষ্টি লাভ করি। তখন থেকে সিরাজুল আলম খান,এরভ ক্ত ছিলাম। এখন ও আছি। তার সততা ও দেশ প্রেম এবং অপূর্ব সাংঘটনিক ক্ষমতা ও সহজ সরল নির্লোভ জীবন যাপন আমাকে বিমুগ্ধ বিমোহিত করে। ৬৮ সালে গ্রেজুয়েশন এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্স এ ভর্তি হবার পর তার ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে যাবার, তাদের নেতৃত্বে কাজ করার সুযোগ পাই।
সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনকে-“ছয়দফার রেফারেন্ডাম-বলে ঘোষনা করেন বাংলা ও বাঙ্গালিদের অবিসংবাদিত নেতা আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙ্গালির মুক্তি সনদ ছয়দফা কর্ম্মসূচীকে সি,আই,এ,র চক্রান্ত এবং বঙ্গবন্ধুকে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের চর বলে অভিহিত করেছিলেন তৎকালীন ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ। অবশ্য পরবর্তী কালে অনেক ভ্রষ্টবাম এর বিভ্রান্তি কেটেছে, অনেকে বাম ধারা পরিহার করে আওয়ামীলীগের নৌকায় সওয়ারী হয়ে সাংসদ, মন্ত্রী হয়েছেন।, দলের ও পদপদবী পেয়েছেন। অবশ্য এরা এখনও ন্যাপ এর অমুক বলে অভিহিত। সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার তুঙ্গে উঠে। সিরাজুল আলম খান এর-নিউক্লিয়াস-বঙ্গবন্ধুর প্রার্থীগণকে বিজয়ী করতে মাঠে ময়দানে কাজ করেন।
সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে পাকিস্তান জতীয় পরিষদ-এম,এন,এ এবং পূর্ব পারিকস্তান প্রাদেশিক পরিষদ এমপিএ-উভয় কক্ষে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে আওয়ামীলীগ। বৃহত্তর সিলেটে মৌলভীবাজার জেলায় সবকটি আসনে জয় লাভ করেন বঙ্গবন্ধু মনোনীত প্রার্থীগণ। প্রতিপক্ষের প্রার্থীগণের কোথাও কোথাও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসাবে দেশে বিদেশে অভিনন্দিত হতে থাকেন।
সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনের পর পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেঃ এ এম এহিয়া খান, নাটেরগুরু লারকানার নবাব জুলিফিকার আলী ভুট্টু, এবং পাঞ্চাবী সেনাচক্র-আমলাতন্ত্রের চক্ষু চড়ক গাছ। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করতঃ পাক সামরীক জান্টা পিন্ডি থেকে বাংলায় সেনা মোতায়েন শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর আহবানে বাংলায় শুরু হয় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। একাত্তোরের অগ্নিঝরা মার্চ মাস। উত্তাল পূর্ব বাংলা। ২ রা মার্চ ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ঐতিহাসিক বট তলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আসম আব্দুর রব। ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সেক্রেটারি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আপোষহীন নেতা শাহজাহান সিরাজ। উত্তাল মার্চ এর এইসব ঐতিহাসিক কর্ম্মসূচীর নেপথ্যে নিউক্লিয়াসের জনক সিরাজুল আলম খাঁন মূল উদ্দেশ্য ও দাবীছিল বাংলাথেকে সেনা শাসনের অবসান। জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। পাকিস্তানী সামরীক শাসক গোষ্টীকে রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া এবং মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি ছিল আন্দোলনকারী নেতৃত্বের পরিকল্পনা। সাতই মার্চ একাত্তোরে রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষন দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সাতই মার্চের ভাষন ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ট এবং ঐতিহাসিক ভাষন। আন্দোলন সংগ্রাম-টানটান উত্তেজনার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে পাক প্রেসিডেন্ট জেঃ এহিয়া-মুজিব ভুট্টু-আলোচনার নামে কাল ক্ষেপন করত থাকেন। দেশব্যাপী চুড়ান্ত উত্তেজনা বিরাজমান থাকা অবস্থায় এলো তেইশে মার্চ একাত্তোর।
তেইশে মার্চ ছিল পাকিস্তানের-রিপাবলিক ডে-প্রজাতন্ত্র দিবস। একাত্তোরের তেইশে মার্চ-স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে-প্রটেষ্ট ডে-প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষনা করে দেশব্যাপী একযুগে কর্মসূচী ঘোষনা করেন। একাত্তোর সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে মাষ্টার্স ফাইন্যাল ইয়ারের পরিক্ষার্থী ছিলাম, হাজী মোহাম্মদ মহসীন হলের আবাসিক ছাত্র হলেও তৎকালীন ইকবাল হল-অতঃপর সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেই থাকতাম। কারন এই হল ছিল দাদা সিরাজুল আলম খাঁন এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের আস্থানা-ঠিকানা। নেতারা নির্দেশ দিলেন চুড়ান্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিজ নিজ এলাকায় চলে যাবার জন্য। বিশেষতঃ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষনের পর ঢাকায় থাকার আর কোন কারন নাই। ফলতঃ নেতাদের নির্দেশে আমি এলাকায় চলে আসি। আমি তখন মহকুমা ছাত্রলীগের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি। এলাকায় এসে মহকুমা ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ও য়াহাব চৌধুরী পেরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। স্বাধীনতা উত্তরকালে জাসদে যোগদান। অতঃপর প্রবাসে। দেশে।)  এবং ছাত্রলীগ সেক্রেটারী (ভাঃ প্রাঃ) নুরুল ইসলাম মুকিত (মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। সংগঠকের দায়িত্ব পালন। অকাল প্রয়াত)-কে নিয়ে স্থানীয় আন্দোলন সংগ্রামে শরীক হই। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর পক্ষ থেকে তেইশে মার্চ একাত্তোর বিকাল বেলা চৌমুহনা চত্বরে ছাত্রগন জামায়েত এর কর্মসূচী ঘোষনা করা হয়। ছাত্র জনতার মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। আমরা উৎসাহের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরী করি। চৌমুহনাস্থ টেইলার বর্শিজুরা নিবাসী আব্দুল বশির পতাকা তৈরীতে আন্তরিকতা ও দূঃসাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।
তেইশে মার্চ একাত্তোর সাল পড়ন্ত বিকাল। চৌমুহনা চত্বর ছাত্র-যুব-জনতায়-লোকে লোকারন্য। তিলধারনের ঠাই নাই। গগন বিদায়ী মূহুর্মূহু জয় বাংলা শ্লোগানের মাঝে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় ছাত্রসভার কাছ। ছাত্রলীগের নব নির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভায় ছাত্রলীগের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে আমাকে প্রধান অতিথি করা হয়। সভাটি পরিচালনা করেছিলেন ছাত্রলীগ নেতা নূরুল ইসলাম মুকিত। আমি তখন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপক্ষে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খুব কড়া বক্তৃতা ও গরম গরম শ্লোগান দিতাম। তখনকার জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল-জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান-আজিমপুরর গুরুস্থান, দুই চারটা মারুয়া ধর সকাল বিকাল নাস্তাকর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, পিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা-ঢাকা, তোমার নেতা-আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইত্যাদি। ইতিপূর্বে কড়া শ্লোগান দেওয়ার কারনে আমার নাকে মুখে রক্তপাত হয়ে অসুস্থ হই, দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলাম। তৎকালীন সিভিল সার্জণ আমাদের আদর্শের সমর্থক ডাঃ আব্দুল হেকিম খুব যতœ সহকারে আমাকে বিনা ফিতে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে আবার সেই ভাষন-শ্লোগানে শুরু করি। সেই সভায়ও উত্তেজিত ভাষনের পর আমি মূহুমূহু জয় বাংলা শ্লোগানের মাধ্যমে প্রথমে চানতারা খচিত পাকিস্তানী পতাকা এবং জিন্নাহ সাহেবের ছবি পুড়াই। পোড়ানো শেষে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা এবং জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি উত্তোলন করি। চৌমুহনা সংলগ্ন এনাম কমপ্লেক্সের দোতলায় ছিল সমশের নগর রোড নিবাসী মঞ্জু চৌধুরীর মালিকানাধীন মুক্তাফটোষ্টুডিও। তারা ছিল জাত ব্যবসায়ী এবং আমাদের রাজনীতির বিরোধী শক্তি। এই ভবনের মালিক ও সোনাপুরের হাজি ইনাম উল্লাহ সাহেব মুসলিমলীগের নেতা এবং সালারে জিলা এম পি ও নিজ ইউ পি চেয়ারম্যান ছিলেন। চৌমুহনাস্থ মুক্তা ষ্টুডিও থেকে তেইশে মার্চের সেই সভার ছবি উঠিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমি নিজে একটি আলোকচিত্রে দেখেছি জিন্নাহ সাহেব এবং পাকিস্তানী পতাকা দাউদাউ করে জ্বলছে এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা অনিন্দ সুন্দর ভাবে উড়ছে।
স্বাধীনতার পর আমি আমার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষাগুরু ঘোষ লজ নিবাসী বাবু বিমল কান্তি ঘোষ সুজন বাবুর মুখে অনেক দিন শুনেছি খানাসেনা এবং ডিবি পুলিশ এই ছবি দেখিয়ে-গুন্ডা মুজিব কাহ্যাহ্যায়-বলে তাকে সহ অনেককেই মারপিট করেেেছ। আমার বিশাল চুল-গুপ এবং ছ’ফুটি ফিগারে আমাকে দৃশ্যতঃ গুন্ডা পান্ডাই লাগত। তারাও আমাকে তাই মনে করতেন। খানসেনাদের হাতে ধরা পড়লে কচু কাটাদিত, পাকিস্তান টিকে থাকলে আমার ও আমাদের কোর্ট মার্শাল হত। আমি আমরা নিছক স্বদেশ প্রেমও স্বাদেশিকতায় উদ্ভোদ্ধ হয়ে নেতাদের নির্দেশে কাজ করেছি। কোন লোভ লালসা অর্থের বিনিময়ে নয়। তখন আমরা নেতাদের ওয়ার্কার ছিলাম কেডার ছিলাম না, নেতারাও আমাদের গডফাদার ছিলেন না, ছিলেন লিডার। দুঃখও দূর্ভাগ্য জনকভাবে তা আজ নেই। কমছে।
তেইশেমার্চ একাত্তোর সমগ্র বাংলাদেশে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে। কেন্টনমেন্ট ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়েনি। চব্বিশেমার্চ আমাদের কাছে সংবাদ এসেছিল কমলগঞ্জ উপজেলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়েনি-প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়নি। তারিখ দিলাম পঁচিশ মার্চেই কমলগঞ্জ যাব। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াবো। পঁচিশে মার্চ বিকালে আওয়ামী স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীর দুই নেতা আব্দুল মছব্বির (পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাধিক মেয়াদে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান) এবং আব্দুল মালিক (খাটিয়ার মহল নিবাসী। পরলোকে) সদলবলে কমলগঞ্জ যাই। রিজেষ্টারী মাঠে বিশাল জনসভায় ভাষন দেই। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াই। জেলার কলংক গুচাই।
তেইশে মার্চ একাত্তোর ছিল পাকিস্তানের শেষ প্রজাতন্ত্র দিবস। কারন এর অর্ধসপ্তাহে মধ্যেই পাকিস্তানের মৃত্যো ঘন্টা বেজে উঠে, জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র-বাংলাদেশ।
তেইশে মার্চ একাত্তোরের উজ্জল স্মৃতি এখনও আমার মনের মনিকোঠায় সমুজ্জল। অমলিন অম্লান। তেইশে মার্চ একাত্তোর প্রতিরাধ দিবসের কুশিলব-সংঘটকগণকে অভিনন্দন। আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(লেখক: সেক্রেটারী, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিওর এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিষ্ট)

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com