হাইল-হাওরে ৬ বছরে কৃষি জমি কমেছে ১৯৫০ হেক্টর॥ মৎস্য খামারের জন্য পুকুর খনন হয়েছে ৩৮০টি
প্রভাবশালী মহলের কোদাল আর খুন্তির আচড়ে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে সিলেটের শষ্য ও মৎস্যভান্ডার বলে খ্যাত শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার উপজেলা এবং নবীগঞ্জ উপজেলার কিয়দংশের আটটি ইউনিয়নের ২৯টি গ্রাম নিয়ে গঠিত বাইক্কা বিল – হাইল হাওর। বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্য হাইল হাওর প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র ও জীবন জীবিকার বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ন জলাভূমি। কিন্তু এ জলাভূমিটি ক্রমশ বদ্ধভূমিতে পরিণত হচ্ছে। হাইল হাওরকে ঘিরে একের পর এক তৈরি হচ্ছে মৎস্য খামারের জন্য পুকুর। হাইল হাওরের প্লাবন ভূমিতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে পুকুরের সংখ্যা। এতে হাওরে মাছের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে, প্রকৃত মৎস্যজীবিরা হচ্ছেন বেকার। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে হাওরের যে জমিতে ফসল উৎপাদন হয় সেসব জমিতে পুকুর কেটে অবাধে মৎস্য খামার করার কারণে কমছে ফসলী জমি। এতে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। যেভাবে দুর্বার গতিতে হাইল হাওরে পুকুরের সংখ্যা বাড়ছে এতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে পুরো এলাকা খাদ্য ও প্রাকৃতিক দেশীয় মৎস্য সংকটে নিপতিত হবে বলে অশংকা করছেন অভিজ্ঞমহল । একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, পুরো হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। এ হাওরে প্রায় ৫ হাজার অতি দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবার মাছ আহরণ নির্বাহ করে থাকেন তাদের জীবিকা। তাছাড়াও হাইল হাওর দেশী বিদেশী নানা প্রজাতির পাখি, শামুক, ঝিনুক, ফোকল, ঘাস, শাপলা, শালুক, উকল, হিজল-করচ গাছ ইত্যাদি এবং অন্যান্য বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। হাইল হাওরের এ প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ তথা এই জলাভূমির উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে মাচ্ প্রকল্পের সহায়তায় সংগঠিত হয়েছে জলাভূমি সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন (আরএমও)। এই সংগঠন হাইল হাওরের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন ও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র রক্ষা করাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছে। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে-হাওরে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ যেমন গইন্না, কালিবাউস, চিতল, গুলশা, আইর, দেশীয় স্বরপুটি, পাবদা, রুই ইত্যাদি অবমুক্তকরণ। এছাড়া হাওরে বিপুল পরিমাণ জলজ গাছ রোপন করা হয়েছে। সেখানে তৈরী হয়েছে বন্যপ্রাণী ও পাখির আবাসস্থল। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার তিন উপজেলা শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলার কিয়দংশ নিয়ে অবস্থিত সুবিশাল হাইল হাওর। সরকারি খাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি মিলিয়ে বর্ষা মৌসুমে মৌলভীবাজারের কালিয়ারগাঁও থেকে শ্রীমঙ্গলের মতিগঞ্জ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১১ কিলোমিটার প্রস্থের হাইল হাওরের শুষ্ক মৌসুমে দৈর্ঘ্য থাকে ১০ কিলোমিটার ও প্রস্থ থাকে ৫ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে সুবিশাল জলরাশির হাইল হাওরে ছোট-বড় মিলিয়ে রয়েছে তিন শতাধিক বিল। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার সামান্য অংশ হাইল হাওরে থাকলে মূলত হাওরটি শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর নামেই পরিচিত। এ হাইল হাওরে প্রতি বছর গড়ে ৬ থেকে ৭ শত টন মাছ উৎপন্ন হয়। এ হাওরের মাছ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী করা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু বর্তমান মৌসুমে হাইল হাওরে ২-৩ টন মাছও উৎপন্ন হবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ খোদ মৎস্য বিভাগেরও। এছাড়া এ হাওরের মাখনা, ভেট ইত্যাদি ফল বিক্রি হয় বাজারে। হাওরে রয়েছে ৩শ ৮০টি পুকুরের ৪০টি মৎস্য খামার, ৪০টি হাঁসের খামার, ১৫টি গরু-মহিষের বাথান। এক সময় বর্ষা মৌসুমে হাইল হাওরের সুনীল জলরাশি চোখ ধাঁধিয়ে দিতো। যে দিকে চোখ যেত শুধু দেখা যেতো পানি আর পানি। হাইল হাওরের পানির প্রধান উৎস গোপলা নদী। (উজানে বিলাসছড়া থেকে উৎপত্তি লাভ করে হাইল হাওরকে দ্বিখন্ডিত করে গোপলা নদী ভাটিতে বিজনা নদীর মাধ্যমে মেঘনার উধাংশের সাথে মিলিত হয়েছে)। হাইল হাওরে এলাকায় গেলে উপভোগ করা যেত অপরূপ সৌন্দর্য। নৌকা ভ্রমনের উৎকৃষ্ট স্থান ছিল হাইল হাওর। ভোরে ঘুমন্ত হাইল হাওর যেন জেগে উঠতো। এক সময় বিশাল জলরাশির এ হাওরের চারপাশে হাজার হাজার মৎস্যজীবির মাছ আহনরণের দৃশ্য অত্যন্ত মোহনীয় লাগতো। বিকেলের হাইল হাওর চলে যেত পাখিদের দখলে। সন্ধ্যায় হাইল হাওরে ভ্রমন করলে মনে হতো সারা রাত কাটিয়ে দেই পাখিদের এ রাজ্যে। কিন্তু এখন হাইল হাওরের সেই রূপ আর চোখে পড়ে না। হাইল হাওরের বুক চিরে মৎস্য খামারিরা গড়ে তুলছেন বিশাল বিশাল পুকুর। পুকুরের চারপাশে রোপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। হাইল হাওরের একপাশ থেকে তাকালে মনে হয় অন্যপাশে হাওরের মাঝে গড়ে ওঠেছে গ্রাম। একটি বিশ্বস্থ্য সূত্রে জানা গেছে, হাইল হাওরের শুধু শ্রীমঙ্গল অংশে ৪০ জন মৎস্য খামারী মৎস্য চাষের জন্য হাওরের ৫১৭.৮২ হেক্টর জমিতে পুকুর কেটেছেন ৩শ ৮০টি। পুকুর থেকে পোনা ও বড় মাছ যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সেজন্য পুকুরের চারপাশে বাধ দেবার কারণে হাইল হাওরের প্লাবন ভূমির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি হাইল হাওরের অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত গোপলা নদীর আশপাশে বাধ নির্মানের ফলে নদীটির গতিপথও বদলে গেছে। হাইল হাওর কেন্দ্রিক এসব মৎস্য খামারে দেশীয় কোন মাছের চাষ হয় না বলে জানা গেছে। খামারগুলোতে দ্রুত বর্ধমান বিদেশী শংকর জাতের মাছের আধিক্য লক্ষনীয়। আর প্রায় সবগুলো খামারের মাছ সিলেট অঞ্চলের বাইরে চলে যায়। ফলে মাছের ভরা মৌসুমেও স্থানীয় বাজারে মাছে তীব্র সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় ওই সূত্রটির দেয়া তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, হাইল হাওরে যে কয়টি মৎস্য খামার গড়ে ওঠেছে তার মধ্যে অধিকাংশই ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি। ওই সূত্রটি মতে উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে মো. আমির হোসেন হাওরের ৭.৫০ হেক্টর ভূমিতে ৮টি পুকুর, মো. বাচ্চু মিয়া ৮ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, মো. মছদ্দর আলী ৬ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো. সানু মিয়া ৩.৫০ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো, সাব মিয়া ৩ হেক্টর জমিতে ৬টি পুকুর, মো, ছালিক মিয়া ২৮ হেক্টর জমিতে ১০টি পুকুর, দেওয়ান মো. বাছিত ১২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, মো, ছায়েদ মিয়া ১২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, মো, এবায়দুর রহমান ৪০ হেক্টর জমিতে ২০টি পুকুর, একই ইউনিয়নের বরুনা গ্রামে মো, তাহির মিয়া ৩ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, মো, আব্দুস শহীদ ১৪ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে মো. অনু মিয়া ৭.৫০ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো. হারুন মিয়া ২ হেক্টর জমিতে ৫টি পুকুর, মো. মোছাব্বির মিয়া ৩.৬৪ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, ইছবপুর গ্রামে মো. মোর্শেদ মিয়া ২.৫০ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, উত্তর ভাড়াউড়া গ্রামে ভানু লাল রায় ২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, সুরজিৎ দাশ ২.২০ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, দক্ষিণ ভাড়াউড়া গ্রামে মো. মছদ্দর আলী ১.৭০ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, সীতেশ রঞ্জন দেব ১.৯০ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, হাজী আতাউর রহমান ২.২০ হেক্টর জমিতে ৬টি পুকুর, ভূনবীর ইউনিয়নের মতিগঞ্জ এলাকার গোলাম মোস্তফা রাজা ২৮০ হেক্টর জমিতে ৭০টি পুকুর, ব্র্যাক মৎস্য খামার ৩০ হেক্টর জমিতে ৫২টি পুকুর, নাইম সরফরাজ ৪.৬০ হেক্টর জমিতে ৬টি পুকুর, কুমারেশ দত্ত ২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, জয়নাল মিয়া ১.২০ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, মো. খালেক মিয়া ১০ হেক্টর জমিতে ১৬টি পুকুর, মো. আফতাব মিয়া ৪ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো. দিদার আমীন ১.৬০ হেক্টর জমিতে ৫টি পুকুর, মো. ছাত্তার মিয়া ১.৮০ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, ভূনবীর গ্রামে মো. আব্দুর রশীদ ৪.২৫ হেক্টর জমিতে ১৪টি পুকুর, মো. ওয়াহিদ মিয়া ২.৮০ হেক্টর জমিতে ১৪টি পুকুর, মো. হান্নান মিয়া ২.৮০ হেক্টর জমিতে ১৪টি পুকুর, লাইফ নেছার এগ্রো ফার্ম ৪ হেক্টর জমিতে ১৭টি পুকুর, রাজপাড়া গ্রামে মো. আছকির মিয়া ১.৫০ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, মো. ছাবু মিয়া ০.৭২ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, মীর্জাপুর ইউনিয়নের কামাসীদ গ্রামে মো. ফজলুল হক ১.০৫ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, বৌলাসীর গ্রামে মো. কামাল মিয়া ১.৪৫ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, যাত্রাপাশা গ্রামে মো. খালেদ মিয়া ০.৮৫ হেক্টর জমিতে ১টি পুকুর, সুইলপুর গ্রামে মো. শামছুল হক ০.৪৮ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর এবং আতাউর রহমান ০.১৮ হেক্টর জমিতে ১টি পুকুর খনন করে মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে হাইল হাওর এলাকায় অধিকাংশ মৎস্য খামারের মালিক তাদের জমির পার্শ্ববর্তী হাওরের সরকারি জমিও ধীরে ধীরে অবৈধভাবে দখলে নিয়ে খামারের পরিধি বৃদ্ধি করছেন। ক্রমশ মৎস্য খামার সংলগ্ন সরকারি খাস জমিতে পড়ছে খামার মালিকদের কোদালের কুপ। এছাড়া সরকার কর্তৃক ভূমিহীন, গরীব কৃষকদের নামে বন্দোবস্ত ও দলিলকৃত হাওরাঞ্চলের ফসলের জমিও কৌশলে অনেকে হাতিয়ে নিয়ে সেখানে গড়ে তুলছেন মৎস্য খামার। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন নজরধারী না থাকায় হাওর কেন্দ্রীয় অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা বেড়েই চলেছে। এদিকে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে মাত্র ৬ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০০৭ সালে হাইল হাওরে ৫ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হতো। হাইল হাওরাঞ্চলে মৎস্য খামার (ফিসারী)র সংখ্যা বৃদ্ধি ও নানা কারণে বর্তমানে ফসলের আওতায় রয়েছে ৩ হাজার ৫শ ৫০ হেক্টর জমি। মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে জমির পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৯শ ৫০ হেক্টর। ২০০৭ সালে প্রতি হেক্টরে বোরো আবাদ হতো ৩.৮৪ টন। সে হিসেবে প্রতি বছরে হাইল হাওর থেকে মোট ধান পাওয়া যেত ২১ হাজার ১শ ২০ টন। বর্তমান সময়ে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, উন্নত মানের বীজ, সার-কীটনাশক পরিমাণ মতো ব্যবহার, কৃষি বিভাগের অধিক এবং কৃষকদের পরিকল্পনার কারণে বর্তমানে প্রতি হেক্টরে ফসল উৎপাদন বেড়ে দাড়িয়েছে ৫.২ টনে। সে হিসেবে বর্তমানে হাইল হাওর থেকে প্রতি বছর ফসল (ধান) পাওয়া যায় ২০ হাজার ৪শ ৪৮ টন। ৬ বছর পূর্বের কৃষি জমি যদি বর্তমানে অটুট থাকতো তবে হাওর থেকে ধান পাওয়া যেত ২৮ হাজার ৬শ টন। অর্থাৎ জমির পরিমান অপরিবর্তিত থাকলে প্রতি বছর ৭ হাজার ৪শ ৮০ টন বাড়তি ফসল পাওয়া যেত। মাত্র ৬ বছরে ফসল উৎপাদন কমেছে ৭ হাজার টনের ওপরে কিন্তু জসসংখ্যা ওই সময়ে বৃদ্ধির হার ১.৩৯ শতাংশ। লোকসংখ্যার আধিক্যে যে পরিমান বাড়তি খাদ্যের প্রয়োজন তার সংস্থানে বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। আগামী ১০ বছরের মধ্যে হয়তো কোদাল আর খুন্তির কুপে ফসল উৎপাদনের জমি আরো অধিক পরিমানে নি:শেষ হয়ে যাবে। তখন এ এলাকায় চরমভাবে দেখা দেবে খাদ্য সংকট-এমনটাই আশংকা করছেন অভিজ্ঞ মহল।
প্রভাবশালী মহলের কোদাল আর খুন্তির আচড়ে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে সিলেটের শষ্য ও মৎস্যভান্ডার বলে খ্যাত শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার উপজেলা এবং নবীগঞ্জ উপজেলার কিয়দংশের আটটি ইউনিয়নের ২৯টি গ্রাম নিয়ে গঠিত বাইক্কা বিল – হাইল হাওর। বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্য হাইল হাওর প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র ও জীবন জীবিকার বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ন জলাভূমি। কিন্তু এ জলাভূমিটি ক্রমশ বদ্ধভূমিতে পরিণত হচ্ছে। হাইল হাওরকে ঘিরে একের পর এক তৈরি হচ্ছে মৎস্য খামারের জন্য পুকুর। হাইল হাওরের প্লাবন ভূমিতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে পুকুরের সংখ্যা। এতে হাওরে মাছের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে, প্রকৃত মৎস্যজীবিরা হচ্ছেন বেকার। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে হাওরের যে জমিতে ফসল উৎপাদন হয় সেসব জমিতে পুকুর কেটে অবাধে মৎস্য খামার করার কারণে কমছে ফসলী জমি। এতে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। যেভাবে দুর্বার গতিতে হাইল হাওরে পুকুরের সংখ্যা বাড়ছে এতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে পুরো এলাকা খাদ্য ও প্রাকৃতিক দেশীয় মৎস্য সংকটে নিপতিত হবে বলে অশংকা করছেন অভিজ্ঞমহল । একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, পুরো হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। এ হাওরে প্রায় ৫ হাজার অতি দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবার মাছ আহরণ নির্বাহ করে থাকেন তাদের জীবিকা। তাছাড়াও হাইল হাওর দেশী বিদেশী নানা প্রজাতির পাখি, শামুক, ঝিনুক, ফোকল, ঘাস, শাপলা, শালুক, উকল, হিজল-করচ গাছ ইত্যাদি এবং অন্যান্য বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। হাইল হাওরের এ প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ তথা এই জলাভূমির উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে মাচ্ প্রকল্পের সহায়তায় সংগঠিত হয়েছে জলাভূমি সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন (আরএমও)। এই সংগঠন হাইল হাওরের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন ও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র রক্ষা করাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছে। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে-হাওরে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ যেমন গইন্না, কালিবাউস, চিতল, গুলশা, আইর, দেশীয় স্বরপুটি, পাবদা, রুই ইত্যাদি অবমুক্তকরণ। এছাড়া হাওরে বিপুল পরিমাণ জলজ গাছ রোপন করা হয়েছে। সেখানে তৈরী হয়েছে বন্যপ্রাণী ও পাখির আবাসস্থল। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার তিন উপজেলা শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলার কিয়দংশ নিয়ে অবস্থিত সুবিশাল হাইল হাওর। সরকারি খাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি মিলিয়ে বর্ষা মৌসুমে মৌলভীবাজারের কালিয়ারগাঁও থেকে শ্রীমঙ্গলের মতিগঞ্জ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১১ কিলোমিটার প্রস্থের হাইল হাওরের শুষ্ক মৌসুমে দৈর্ঘ্য থাকে ১০ কিলোমিটার ও প্রস্থ থাকে ৫ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে সুবিশাল জলরাশির হাইল হাওরে ছোট-বড় মিলিয়ে রয়েছে তিন শতাধিক বিল। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার সামান্য অংশ হাইল হাওরে থাকলে মূলত হাওরটি শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর নামেই পরিচিত। এ হাইল হাওরে প্রতি বছর গড়ে ৬ থেকে ৭ শত টন মাছ উৎপন্ন হয়। এ হাওরের মাছ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী করা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু বর্তমান মৌসুমে হাইল হাওরে ২-৩ টন মাছও উৎপন্ন হবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ খোদ মৎস্য বিভাগেরও। এছাড়া এ হাওরের মাখনা, ভেট ইত্যাদি ফল বিক্রি হয় বাজারে। হাওরে রয়েছে ৩শ ৮০টি পুকুরের ৪০টি মৎস্য খামার, ৪০টি হাঁসের খামার, ১৫টি গরু-মহিষের বাথান। এক সময় বর্ষা মৌসুমে হাইল হাওরের সুনীল জলরাশি চোখ ধাঁধিয়ে দিতো। যে দিকে চোখ যেত শুধু দেখা যেতো পানি আর পানি। হাইল হাওরের পানির প্রধান উৎস গোপলা নদী। (উজানে বিলাসছড়া থেকে উৎপত্তি লাভ করে হাইল হাওরকে দ্বিখন্ডিত করে গোপলা নদী ভাটিতে বিজনা নদীর মাধ্যমে মেঘনার উধাংশের সাথে মিলিত হয়েছে)। হাইল হাওরে এলাকায় গেলে উপভোগ করা যেত অপরূপ সৌন্দর্য। নৌকা ভ্রমনের উৎকৃষ্ট স্থান ছিল হাইল হাওর। ভোরে ঘুমন্ত হাইল হাওর যেন জেগে উঠতো। এক সময় বিশাল জলরাশির এ হাওরের চারপাশে হাজার হাজার মৎস্যজীবির মাছ আহনরণের দৃশ্য অত্যন্ত মোহনীয় লাগতো। বিকেলের হাইল হাওর চলে যেত পাখিদের দখলে। সন্ধ্যায় হাইল হাওরে ভ্রমন করলে মনে হতো সারা রাত কাটিয়ে দেই পাখিদের এ রাজ্যে। কিন্তু এখন হাইল হাওরের সেই রূপ আর চোখে পড়ে না। হাইল হাওরের বুক চিরে মৎস্য খামারিরা গড়ে তুলছেন বিশাল বিশাল পুকুর। পুকুরের চারপাশে রোপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। হাইল হাওরের একপাশ থেকে তাকালে মনে হয় অন্যপাশে হাওরের মাঝে গড়ে ওঠেছে গ্রাম। একটি বিশ্বস্থ্য সূত্রে জানা গেছে, হাইল হাওরের শুধু শ্রীমঙ্গল অংশে ৪০ জন মৎস্য খামারী মৎস্য চাষের জন্য হাওরের ৫১৭.৮২ হেক্টর জমিতে পুকুর কেটেছেন ৩শ ৮০টি। পুকুর থেকে পোনা ও বড় মাছ যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সেজন্য পুকুরের চারপাশে বাধ দেবার কারণে হাইল হাওরের প্লাবন ভূমির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি হাইল হাওরের অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত গোপলা নদীর আশপাশে বাধ নির্মানের ফলে নদীটির গতিপথও বদলে গেছে। হাইল হাওর কেন্দ্রিক এসব মৎস্য খামারে দেশীয় কোন মাছের চাষ হয় না বলে জানা গেছে। খামারগুলোতে দ্রুত বর্ধমান বিদেশী শংকর জাতের মাছের আধিক্য লক্ষনীয়। আর প্রায় সবগুলো খামারের মাছ সিলেট অঞ্চলের বাইরে চলে যায়। ফলে মাছের ভরা মৌসুমেও স্থানীয় বাজারে মাছে তীব্র সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় ওই সূত্রটির দেয়া তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, হাইল হাওরে যে কয়টি মৎস্য খামার গড়ে ওঠেছে তার মধ্যে অধিকাংশই ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি। ওই সূত্রটি মতে উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে মো. আমির হোসেন হাওরের ৭.৫০ হেক্টর ভূমিতে ৮টি পুকুর, মো. বাচ্চু মিয়া ৮ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, মো. মছদ্দর আলী ৬ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো. সানু মিয়া ৩.৫০ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো, সাব মিয়া ৩ হেক্টর জমিতে ৬টি পুকুর, মো, ছালিক মিয়া ২৮ হেক্টর জমিতে ১০টি পুকুর, দেওয়ান মো. বাছিত ১২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, মো, ছায়েদ মিয়া ১২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, মো, এবায়দুর রহমান ৪০ হেক্টর জমিতে ২০টি পুকুর, একই ইউনিয়নের বরুনা গ্রামে মো, তাহির মিয়া ৩ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, মো, আব্দুস শহীদ ১৪ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে মো. অনু মিয়া ৭.৫০ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো. হারুন মিয়া ২ হেক্টর জমিতে ৫টি পুকুর, মো. মোছাব্বির মিয়া ৩.৬৪ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, ইছবপুর গ্রামে মো. মোর্শেদ মিয়া ২.৫০ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, উত্তর ভাড়াউড়া গ্রামে ভানু লাল রায় ২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, সুরজিৎ দাশ ২.২০ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, দক্ষিণ ভাড়াউড়া গ্রামে মো. মছদ্দর আলী ১.৭০ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, সীতেশ রঞ্জন দেব ১.৯০ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, হাজী আতাউর রহমান ২.২০ হেক্টর জমিতে ৬টি পুকুর, ভূনবীর ইউনিয়নের মতিগঞ্জ এলাকার গোলাম মোস্তফা রাজা ২৮০ হেক্টর জমিতে ৭০টি পুকুর, ব্র্যাক মৎস্য খামার ৩০ হেক্টর জমিতে ৫২টি পুকুর, নাইম সরফরাজ ৪.৬০ হেক্টর জমিতে ৬টি পুকুর, কুমারেশ দত্ত ২ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, জয়নাল মিয়া ১.২০ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, মো. খালেক মিয়া ১০ হেক্টর জমিতে ১৬টি পুকুর, মো. আফতাব মিয়া ৪ হেক্টর জমিতে ৮টি পুকুর, মো. দিদার আমীন ১.৬০ হেক্টর জমিতে ৫টি পুকুর, মো. ছাত্তার মিয়া ১.৮০ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, ভূনবীর গ্রামে মো. আব্দুর রশীদ ৪.২৫ হেক্টর জমিতে ১৪টি পুকুর, মো. ওয়াহিদ মিয়া ২.৮০ হেক্টর জমিতে ১৪টি পুকুর, মো. হান্নান মিয়া ২.৮০ হেক্টর জমিতে ১৪টি পুকুর, লাইফ নেছার এগ্রো ফার্ম ৪ হেক্টর জমিতে ১৭টি পুকুর, রাজপাড়া গ্রামে মো. আছকির মিয়া ১.৫০ হেক্টর জমিতে ৭টি পুকুর, মো. ছাবু মিয়া ০.৭২ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, মীর্জাপুর ইউনিয়নের কামাসীদ গ্রামে মো. ফজলুল হক ১.০৫ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর, বৌলাসীর গ্রামে মো. কামাল মিয়া ১.৪৫ হেক্টর জমিতে ৩টি পুকুর, যাত্রাপাশা গ্রামে মো. খালেদ মিয়া ০.৮৫ হেক্টর জমিতে ১টি পুকুর, সুইলপুর গ্রামে মো. শামছুল হক ০.৪৮ হেক্টর জমিতে ৪টি পুকুর এবং আতাউর রহমান ০.১৮ হেক্টর জমিতে ১টি পুকুর খনন করে মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে হাইল হাওর এলাকায় অধিকাংশ মৎস্য খামারের মালিক তাদের জমির পার্শ্ববর্তী হাওরের সরকারি জমিও ধীরে ধীরে অবৈধভাবে দখলে নিয়ে খামারের পরিধি বৃদ্ধি করছেন। ক্রমশ মৎস্য খামার সংলগ্ন সরকারি খাস জমিতে পড়ছে খামার মালিকদের কোদালের কুপ। এছাড়া সরকার কর্তৃক ভূমিহীন, গরীব কৃষকদের নামে বন্দোবস্ত ও দলিলকৃত হাওরাঞ্চলের ফসলের জমিও কৌশলে অনেকে হাতিয়ে নিয়ে সেখানে গড়ে তুলছেন মৎস্য খামার। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন নজরধারী না থাকায় হাওর কেন্দ্রীয় অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা বেড়েই চলেছে। এদিকে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে মাত্র ৬ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০০৭ সালে হাইল হাওরে ৫ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হতো। হাইল হাওরাঞ্চলে মৎস্য খামার (ফিসারী)র সংখ্যা বৃদ্ধি ও নানা কারণে বর্তমানে ফসলের আওতায় রয়েছে ৩ হাজার ৫শ ৫০ হেক্টর জমি। মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে জমির পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৯শ ৫০ হেক্টর। ২০০৭ সালে প্রতি হেক্টরে বোরো আবাদ হতো ৩.৮৪ টন। সে হিসেবে প্রতি বছরে হাইল হাওর থেকে মোট ধান পাওয়া যেত ২১ হাজার ১শ ২০ টন। বর্তমান সময়ে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, উন্নত মানের বীজ, সার-কীটনাশক পরিমাণ মতো ব্যবহার, কৃষি বিভাগের অধিক এবং কৃষকদের পরিকল্পনার কারণে বর্তমানে প্রতি হেক্টরে ফসল উৎপাদন বেড়ে দাড়িয়েছে ৫.২ টনে। সে হিসেবে বর্তমানে হাইল হাওর থেকে প্রতি বছর ফসল (ধান) পাওয়া যায় ২০ হাজার ৪শ ৪৮ টন। ৬ বছর পূর্বের কৃষি জমি যদি বর্তমানে অটুট থাকতো তবে হাওর থেকে ধান পাওয়া যেত ২৮ হাজার ৬শ টন। অর্থাৎ জমির পরিমান অপরিবর্তিত থাকলে প্রতি বছর ৭ হাজার ৪শ ৮০ টন বাড়তি ফসল পাওয়া যেত। মাত্র ৬ বছরে ফসল উৎপাদন কমেছে ৭ হাজার টনের ওপরে কিন্তু জসসংখ্যা ওই সময়ে বৃদ্ধির হার ১.৩৯ শতাংশ। লোকসংখ্যার আধিক্যে যে পরিমান বাড়তি খাদ্যের প্রয়োজন তার সংস্থানে বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। আগামী ১০ বছরের মধ্যে হয়তো কোদাল আর খুন্তির কুপে ফসল উৎপাদনের জমি আরো অধিক পরিমানে নি:শেষ হয়ে যাবে। তখন এ এলাকায় চরমভাবে দেখা দেবে খাদ্য সংকট-এমনটাই আশংকা করছেন অভিজ্ঞ মহল। বিশেষ প্রতিনিধি॥
মন্তব্য করুন