নীরবে বাড়ানো ভালো মানবতার হাত
এহসান বিন মুজাহির॥ করোনা ভাইরাসের কারণে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে আছে দেশ। এতে সারাদেশে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন। অনেক মানুষের বাসা-বাড়িতে অল্প স্বল্প খাবার যা ছিলো এতো দিনে তা ফুরিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত অনেকেই ঋণের বোঝা নিয়ে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছেন। খাদ্য সংকট ও অর্থকষ্টে ভুগলেও সামাজিক মান সম্মানের বিষয় চিন্তা করে ও লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খুলে মধ্যভিত্তরা কিছু বলতেও পারছেন না। তাঁদের চাপা কান্না ঘরের ভেতরেই। নিদারুণ কষ্ট ও দুঃসহ যন্ত্রণায় তাঁরা আজ কাতর।ঘররবন্দি কর্মহীন মানুষরা আজ বর্ণনাতীত উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে থেকে উত্তরণের জন্য নিম্ন আয়ের মানুষ ও হতদরিদ্রের মাঝে সাহায্যেও হাত প্রসারিত করছে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অনেক জেলা-উপজেলায় ইউএনও পুলিশ দ্রুত সেবা প্রদানের জন্য ‘হটলাইন’ চালু করেছেন। যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। ঘরে ঘরেও প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং সদস্যরা খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ঘরে সরকার, প্রশাসন বা কোনো সংস্থা কি খাবার পৌছাচ্ছেন? খোঁজখবর রাখেছেন এসব পরিবার কিভাবে চলছে? বিপদগ্রস্ত, অভাবী, অসচ্চল, দিনমজুর এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজন আজ খুবই দুর্দশায় দিনাতিপাত করছেন।
মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত প্রত্যেক মানুষের সুখের দিনে তাদের পাশে থেকে আনন্দ ভাগাভাগি করার কথা। মানুষের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন কবি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেছিলেন-সবার সুখে হাসবো আমি, কাঁদবো সবার দুখে, নিজের খাবার বিলিয়ে দিব অনাহারির মুখে।
নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে অপরের মুখে হাসি ফোটানোর উদ্দেশ্যে আমরা কতজন পেরেছি? এখন তো পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, নিজের খাবার অন্যকে বিলিয়ে দেয়া তো দূরের কথা, বরং অন্যের মুখের খাবার কেড়ে নেয়ার প্রবণতা লক্ষ করছি।
এখন পৃথিবী যেন এক হাশরের ময়দান। যেন কেয়ামতের আজাব নামিয়ে করোনা ভাইরাস শেষ বিচারের ময়দানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যার যার ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি অবস্থা। এক মর্মান্তিক পরিণতি নেমে এসেছে মানবজাতির জীবনে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার এক অভিনব অসহায় পন্থা। যেখানে একজন আক্রান্ত হলে গোটা বাড়ি বা এলাকা লকডাউন হচ্ছে। স্বামী আক্রান্ত হলে স্ত্রী-সন্তান পাশেই যেতে পারছে না। স্ত্রী আক্রান্ত হলে একই অবস্থা। এমনকি সন্তানের মৃত্যুশয্যায় মা স্পর্শ করা দূরে থাক পাশেই দাঁড়াতে পারছেন না! কোনো কোনো জায়গায়
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণে লাশের গোসল, জানাজা পড়ানোর মতো মানুষ খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দুনিয়ায় দেখবে মানুষ কল্পনাও করেনি।
কিন্তু এই সময়ও গরিবের হক নষ্ট করে দুর্নীতি ত্রাণ চুরি করছে কিছু মানুষ! এই পরিস্থিতিতেও কিছু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নিচ্ছে। এখনও একশ্রেণীর মানুষ বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন। গরিবদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। তবে
অনেকেই স্বল্পপরিসরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত কবি জসিম উদ্দিনের
মতো করে চিন্তা করা। কবির মতো গরিব অসহায়
মানুষকে ভালোবাসা। প্রতিবেশীকে উপোস রেখে নিজে খাওয়ার মাঝে, বিলাসিতার মাঝে আসলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না। প্রকৃত তৃপ্তি তখনই পাওয়া যায় যখন কারও প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়।
হাদিসে আছে এমনভাবে দান করুন, যাতে ডান হাতের দান বাম হাতেও টের না পায়। আজকাল দানের যে দৃশ্য চোখে পড়ে তাতে খুব আহত লাগে। একটি সামান্য প্যাকেট একজন অভাবী মানুষকে দেওয়ার জন্য ডজন ডজন মানুষ ক্যামেরা দিকে দাঁত ভাসিয়ে হাসেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ছবি ভরে গেছে।একটি উদ্যোগের কত যে ছবি ফেসবুকে আপলোড করা যায় তা তো আমরা এখন ফেসবুকের কল্যাণে নিয়মিত দেখি।
বিপদের সময় মানুষের উপকার করার আগ্রহকে ছোট করে দেখছি না। ছবি তোলাকেও আমি খারাপ বলছি না। আমি নিজেও সেই সুযোগ নিই। কিন্তু অন্যকে সামান্য সাহায্য দেওয়ার সময় কেন এতো বেশি প্রচার করতে হবে? এই দেওয়া আপনি কতদিন দিতে পারবেন? একদিন, দুইদিন, এর চেয়েও বেশি! মনে হয় না। যেভাবে পর্যায়ক্রমে ফেসবুকিং ত্রাণ সিস্টেম চলছে তাতে বিরক্ত হচ্ছি। আসুন কর্মহীন অসহায় মানুষের পাশে নীরবে মানবতার হাত বাড়িয়ে দেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও
প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন