যে কারণে হাকালুকি হাওরের বাসিন্দা ইলিশ
হোসাইন আহমদ॥ তীব্র স্রোত এবং গভীর জলের বাসিন্দা রূপালি ইলিশ এখন কালে ভদ্রে নয় সচরাচর ধরাপড়ছে হাওরের বদ্ধ পরিসরে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর হাওর হাকালুকিতে তাই ইলিশ ধরার প্রতিযোগীতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে গত এক মাস যাবৎ। পেশাজীবি জেলেদের বেঁড় জালের প্রতি টানে ১০/১৫টি ছোট বড় সাইজের ইলিশ ধরা পড়ছে। এ নিয়ে কৌতুহলের দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছে হাওর অঞ্চলে।
তবে ইলিশ শিকার নিয়ে সিলেট অঞ্চলে কিংবদন্তি আছে অনেক। রয়েছে ধামালিও। মেয়েলি কন্ঠের ধামালিতে উচ্চারিত হতো “ইলিশায় উঠিয়া বলে আমার বড় পেটি, আমারে বানাইতে লাগে চেয়ারম্যানের বেটি-ওমাছ ইলিশারে”। ইলিশের এই আভিজাত্য গড়ে উঠেছিল কুশিয়ারা অববাহিকার বিভিন্ন জনপদে। জনশ্রুতি আছে, আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচুর ইলিশ ধরাপড়ত জেলেদের জালে। কুশিয়ারা এবং মনুনদীর সঙ্গমস্থল মৌলভীবাজারের অবলুপ্ত মনুমুখ নৌবন্দরকে ঘিরে ৫০ এর দশক পর্যন্ত ইলিশের হাট বিদ্যমান ছিল। তা ছাড়া সিলেটের শেরপুর এবং হবিগঞ্জের মারকুলি ঘাটেও চাহিদা মাফিক ইলিশ মিলত। কিন্তু ৫/৬ দশকের বৈরি পরিবেশের কারণে ক্রমেই কুশিয়ারা নদীতে ইলিশের উপস্থিতি হ্রাস পেতে শুরু করে। বিশেষত, নদী ভরাট এবং ফেঞ্চুগঞ্জের সার কারখানার নির্গত বর্জ্য ইলিশ বসবাসের জন্য বৈরি হয়ে উঠে। জেলেদের জালে কালে ভদ্রে ইলিশ ধরাপড়ত কম মাত্রায় এবং বিক্ষিপ্ত ভাবে। হালে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন শুধু কুশিয়ারা নদীতে নয়, মনুনদীতেও জেলেদের জালে ইলিশের জাটকা ও মধ্যমানের ইলিশ ধরাপড়ছে। বাড়তি খবর হলো-হাকালুকি হাওরেও ইলিশের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। হাওর কিনারের জেলেদের জালে ইলিশ ধরাপড়ছে অবলীলায়।
এ ব্যাপারে ম্যৎস বিশেষজ্ঞ নৃপেন্দ্র কুমার দাসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, দিন বদলের পরিক্রমায় লুপ্ত অতীত এখন সম্ভবাবনাময় বর্তমান হয়ে হাতছানি দিচ্ছে। তার মতে, সিলেট অঞ্চলের কুশিয়ারা নদী এক সময় ছিল ইলিশের অন্যতম চারণ ক্ষেত্র। ভারতের বরাক নদীর এই শাখাটি সিলেটের অমলসিদ থেকে কুশিয়ারা নাম ধারণ করে এক পর্যায়ে বিবিয়ানা ও ভেঁড়া মোহনায় রূপান্তরিত হয়ে মেঘনার সাথে মিশেছে। তাই সঙ্গত কারণে মেঘনা নদী থেকে মৌসুমকালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উজান মুখি হয়ে ছুটে আসত কুশিয়ারা অববাহিকায়। এক সময় বৈরি পরিবেশের কারণে ইলিশের উজান অবিযাত্রা ব্যাহত হলেও এখন ফিরে আসছে অনুকুল পরিবেশ। তাই ইলিশের উপস্থিতি এখন বৃদ্ধি পচ্ছে কুশিয়ারাতে। বিশেষত নদীর ভাটিতে ড্রেজিং শুরু হওয়ায় এবং ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু হওয়াতে কুশিয়ারা তলের জলজ পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, যা ইলিশ উপস্থিতির ক্ষেত্রে সহায়ক। এছাড়া প্রজনন মৌসুমে জাটকা সংরক্ষণে সরকারি পদক্ষেপ কার্যকর থাকায় নদীতে সামুুদ্রিক ইলিশের উপস্থিতি বেড়েছে। অতীতের চাইতে কুশিয়ারা নদীতে বেশি মাত্রায় ছুটে আসছে ইলিশ। এটি এক নতুন সম্ভবনা। নদীর ইলিশের হাওরে অবস্থান গ্রহণ সম্ভবনার ক্ষেত্রকে করেছে প্রসারিত।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট ও মৌলভীবাজারের ৫টি উপজেলায় ১৮১ বর্গ কিঃ আয়তন বিশিষ্ট ও সুবিস্তৃত হাকালুকির অথৈ জলরাঁশি ছোট বড় ৩টি সংযোগ নদী দিয়ে কুশিয়ারায় নির্গত হচ্ছে। সংযোগ নদী সমূহের স্রোতঠেলে দলবদ্ধ ইলিশ ছুটে আসছে হাকালুকি হাওরে। হাওরের ৭/৮টি জলাশয় আছে যেখানে পানির গভীরতা ২৫/৩০ ফুট পর্যন্ত। এই গভীর জলাশয়েই থিতু হবার পথ খোঁজছে ঝাকে ঝাকে আগত ইলিশ। হিজরতি এই ইলিশের ঝাঁক থেকে দলছুট অবস্থায় কিছু কিছু ইলিশ ধরাপড়ছে শিকারীদের বেঁড়জালে।
তারা আলো বলেন, বিশাল হাকালুকি হাওরে যে ৪/৫ টি মৎস্য অভয়াশ্রম আছে তাতে যদি ইলিশের বসবাস নির্বিঘœ হয় তাহলে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশের কুশিয়ারাতে নেমে ডিম ছাড়া অসম্ভব কিছু নয়। যদি এই সম্ভবনার ক্ষেত্র নিশ্চিত হয় তাহলে সিলেট অঞ্চলের কুশিয়ারার ইলিশ এক নতুন ব্র্যান্ড হিসেবে আবির্ভুত হবে বৈকি।
মন্তব্য করুন